শেরপুর থেকে এস এম আশরাফুল ইসলামঃ
শেরপুর জেলার গারো পাহাড়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযান চালিয়ে প্রশাসন ক্লান্ত হয়ে পরলেও থামছে না বালু লোপাট। প্রশাসন একদিকে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে মোবাইল কোর্ট করে জেল-জরিমান এবং বালু উত্তোলনের যন্ত্রপাতি ধ্বংস করে আসলেও একটু পর ফের ভালো উত্তোলন শুরু করছে বালু খেকুরা।
জানাগেছে, উপজেলা প্রশাসনের কতিপয় অসাধ কর্মচারী এবং বন বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তার যোগশাজসেই নদী-নালা, খাল-বিল ঝর্ণা, ফসলি জমি ও পাহাড়সহ নদীর পাড় কেটে বালু লুটপাটের উৎসব চলছে। ইজারাকৃত ভোগাই, চেল্লাখালি, মহারশী, সোমেশ্বরী ও বুরুঙ্গা নদীর ইজারা বহির্ভূত এলাকা থেকেও প্রতিদিন বালু লুটপাট চালিয়ে আসছে বালুদস্যুরা।
ইতোমধ্যেই অবৈধ বালুর গাড়ি আটক করলে বালুদস্যুরা ঝিনাইগাতী উপজেলা পরিষদ ঘেরাও করে নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আলম রাসেলসহ এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দিতে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সাহায্য নিতে হয়।
এদিকে নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলা প্রশাসন দফায় দফায় ভ্রাম্যমাণ আদালতে বালু তোলার সরঞ্জাম ভাঙচুর ও অবৈধ বালু জব্দ করতে করতে প্যারেশান হয়ে পড়লেও বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ বালু উত্তোলন। জানা গেছে যে, বন বিভাগের কিছু কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা কর্মচারীর যোগশাজসেই বালু উত্তোলন চলছে।
বন বিভাগের নালিতাবাড়ী উপজেলার মধুটিলা রেঞ্জ অফিসার রফিকুল ইসলাম জানান, বালু লুটপাট বন্ধে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে তারাও হুমকির মধ্যে রয়েছেন।
বনবিভাগের ঝিনাইগাতী উপজেলার রাংটিয়া ফরেস্ট রেঞ্জে কর্মরত সহকারি বন সংরক্ষক এসডি মো. তানভীর আহমেদ ইমন জানায়, লোকবলের অভাবে বালু লুটপাট প্রতিরোধে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জনবল বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে।
জানা গেছে, গজনীসহ আশপাশের বন বিটের বন কর্মকর্তাদের যোগশাজসেই অবাধে বালু লোপাট হচ্ছে। প্রসঙ্গত, পতিত সরকারের আমলেও বালু পাথর লুটপাট করা হয়। কিন্তু বর্তমান সরকারকে বিতর্কিত করতে গারো পাহাড় ধ্বংস করে লোপাট করা হচ্ছে মূল্যবান খনিজ সম্পদ।
এরা বহু দিন ধরে চোরা পথে বালু লোপাট করে আসছে। এদের কোন রাজনৈতিক পরিচয় নেই। মূলত এরা বালুদস্যু। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তখন সেই সরকারি দলের পরিচয়েই পাথর-বালি লোপাট করে।
অপর দিকে, নদী থেকে বালু ইজারাকৃত নদীতেই সীমাবদ্ধতা নেই বালি লোপাট হচ্ছে ইজারা বহির্ভূত এলাকা থেকেও। বর্তমানে অসংখ্য নতুন বালু মহাল সৃষ্টি করেছে বালুসন্ত্রাসীরা।
বালুদস্যদের থাবায় ক্ষতবিক্ষত ইজারাকৃত নদীর পাড়, গারো পাহাড়, খালবিল নদী-নালা, ফসলি জমি। নির্বিচারে বালু উত্তোলনে হুমকির সম্মুখীন নাকুগাঁও স্থলবন্দর, নদীর তীরবর্তী জনবসতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বুরুঙ্গা সেতুসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সৌন্দর্য হারাচ্ছে পর্যটন কেন্দ্রগুলো।
এছাড়া বালু পরিবহনে ভারি যানবাহন চলাচলে সীমান্ত সড়কের ক্ষতি ছাড়াও পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন। সরকারও বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল রাজস্ব থেকে।
জেলা ও উপজেলা প্রশাসন সুত্রে জানা গেছে, বাংলা ১৪৩২ সালের ১ বৈশাখের পূর্বেই ভোগাই, চেল্লাখালি, মহারশি ও সোমেশ্বরী নদীর ৪টি বালু মহাল ইজারা দেয়া হয়। সরকার পতনের পর চেল্লাখালি নদীর বুরুঙ্গা বালু মহালটি ইজারা দেয়া হয়।
কিন্তু নির্বিচারে নদীর পাড়, ফসলি জমি খালবিল, নদী নালা, ছড়া, ঝর্ণা বনবিভাগের সামাজিক বনের খালবিল, নদী-নালাসহ বিভিন্ন জলাশয়ে নতুন বালু মহালের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে। এসব থেকে নির্বিচারে দিনরাত বালু লুটপাট করা হচ্ছে।
জানা যায়, ইজারার শর্ত ও নিয়ম অনুযায়ী ইজারাকৃত নির্ধারিত স্থানের নদীর তলদেশ থেকে উর্বর বালু উত্তোলনের কথা। কিন্তু শর্তের তোয়াক্কা না করে নদীর পাড় ভেঙে ফসলি জমি ও পাহাড়ে ৫০/৬০ ফুট গর্ত করে বালু লুটপাট চালছে। প্রশাসন ইজারা বহির্ভূত এলাকার বালু লুটপাট বন্ধে অভিযান পরিচালনা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একদিকে অভিযান করা হলে। অপরদিক থেকে বালু লুটপাট করা হচ্ছে। প্রশাসন চলে আসার পরই আবারও শুরু হচ্ছে বালু লুটপাট। অভিযানে ধ্বংস করা হচ্ছে বালু উত্তোলন যন্ত্র। দেয়া হচ্ছে জড়িতদের কারাদণ্ড। করা হচ্ছে জরিমানা। এরপরেও বন্ধ হচ্ছে না বালু লুটপাট।
নালিতাবাড়ী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) আনিসুর রহমান বলেন, প্রশাসনিক কাজের ৮০ ভাগ সময় দিতে হচ্ছে বালু লুটপাট প্রতিরোধে অভিযান পরিচালনায়।
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, বালু লুটপাট বন্ধে অভিযান চলছে। জেল জরিমানা ও বালু উত্তোলনের যন্ত্র ধ্বংস করা হচ্ছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে।
শ্রীবরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জাবের আহমেদ বলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা আক্তার ববি বলেন, যোগদানের পর থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযান পরিচালনা করছেন।
একদিকে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অন্যদিকে উত্তোলন করা হচ্ছে। চলে আসার পর আবারও শুরু হচ্ছে বালু উত্তোলন। তার মতে যারা অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে সহযোগিতা করার কথা, তারাই বালু উত্তোলন করছে।
তিনি বলেন, সীমান্তে কর্মরত বিজিবি, বনবিভাগসহ সুশীল সমাজের সকালের সহযোগিতা ছাড়া বালু লুটপাট বন্ধ করা সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরদার মাহমুদুর রহমান বলেন, আমরা ক্লান্ত না, অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে আরো কঠোরভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। অচিরেই তা দেখতে পাবেন।
এসময়/