
অনন্তলোকে ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান।
মোঃ শাহজাহান বাশার ,স্টাফ রিপোর্টারঃ
বাংলাদেশের বরেণ্য ভাস্কর, খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী ও গুণী শিক্ষাবিদ হামিদুজ্জামান খান আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আজ রবিবার সকাল ১০টায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই প্রথিতযশা শিল্পী। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
হামিদুজ্জামান খানের স্ত্রী, বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী আইভি জামান গণমাধ্যমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। গত সপ্তাহে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। চিকিৎসকরা জানান, তিনি নিউমোনিয়া ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে প্রথমে আইসিইউ, পরে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। আজ সকালে লাইফ সাপোর্ট খুলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
১৯৪৬ সালের ১৬ মার্চ কিশোরগঞ্জ জেলার সহশ্রাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হামিদুজ্জামান খান। তাঁর শিল্পচর্চার যাত্রা শুরু হয় ৬০-এর দশকে। ১৯৭০ সালে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগে। সেখানে ২০১২ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন তিনি। একজন গুণী শিক্ষক হিসেবে তিনি চারুকলা জগতের অগণিত শিক্ষার্থীর জীবনে প্রেরণা হয়ে ছিলেন।
হামিদুজ্জামান খান ফর্ম, বিষয়ভিত্তিক ব্যাখ্যা ও নিরীক্ষাধর্মী ভাস্কর্যের জন্য সমাধিক পরিচিত। তাঁর কাজ ছিল একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত, তেমনি অন্যদিকে ছিল প্রকৃতি, মানবদেহ এবং বিমূর্ত চিন্তার সৌন্দর্য ও গভীরতার প্রতিফলন।
১৯৭৬ সালে তিনি নির্মাণ করেন স্মরণীয় ভাস্কর্য ‘একাত্তর স্মরণে’, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করে। ১৯৮৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অলিম্পিক ভাস্কর্য পার্কে স্থাপন করেন ‘স্টেপস’ শিরোনামের একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাস্কর্য, যা তাঁকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করে তোলে।
ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের উল্লেখযোগ্য কিছু শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে—‘হামলা’ (সিলেট ক্যান্টনমেন্ট),‘পাখি পরিবার’ (বঙ্গভবন) ‘সংশপ্তক’ (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) ‘শান্তির পায়রা’ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র)
তিনি জলরঙ ও অ্যাক্রেলিকে বিমূর্ত ধারায় নিসর্গ ও মানবশরীর চিত্রায়নে পারদর্শী ছিলেন। চারুকলার ভিন্ন মাধ্যমে তাঁর বিচরণ ছিল অনন্য ও সৃজনশীলতায় পরিপূর্ণ।
তাঁর শিল্পীজীবনের স্বীকৃতি স্বরূপ হামিদুজ্জামান খান ২০০৬ সালে একুশে পদক লাভ করেন। বাংলা একাডেমির ফেলো হিসেবে তিনি ২০২২ সালে নির্বাচিত হন। তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর আয়োজন করে ‘হামিদুজ্জামান খান ১৯৬৪–২০১৭’ শিরোনামে বিশাল রেট্রোস্পেকটিভ প্রদর্শনী।
জীবদ্দশায় তাঁর একক প্রদর্শনী হয়েছে ৪৭টি। দেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ গাজীপুরের কড্ডায় তাঁর ভাস্কর্য সংগ্রহ নিয়ে গড়ে তুলেছে বিশাল ভাস্কর্য বাগান, যা তাঁর সৃষ্টিশীলতার এক অনন্য দলিল।
১৯৭৬ সালে আইভি জামানকে বিয়ে করেন হামিদুজ্জামান খান। আইভি জামান নিজেও চারুকলার শিক্ষার্থী এবং পেশাগতভাবে একজন চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর। এই শিল্পী দম্পতির দুই পুত্র—জুবায়ের জামান খান, যিনি একজন আলোকচিত্রী, এবং জারিফ হামিদুজ্জামান।
হামিদুজ্জামান খানের মৃত্যুতে দেশের শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনে গভীর শোক নেমে এসেছে। বহু প্রজন্মের শিল্পী, শিক্ষার্থী ও দর্শকের মনে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্মাণে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
তার এই অবসান শুধু একজন শিল্পীর মৃত্যু নয়, বরং একটি যুগের অবসান। তাঁর স্মরণে দেশের শিল্পাঙ্গনে বিশেষ প্রদর্শনী ও শ্রদ্ধানুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিল্পকলা একাডেমির কর্মকর্তারা।
এসময়/