
খায়রুল হক: ইতিহাসের কাঠগড়ায় এক বিতর্কিত নাম -অ্যাড. মোঃ আরিফুর রহমান শ্রাবণ।
মোঃ শাহজাহান বাশার, স্টাফ রিপোর্টারঃ
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে হত্যা মামলার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযুক্ত হলেন এ.বি.এম. খায়রুল হক, একজন বিচারপতি, যিনি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দায়িত্বে থাকাকালে এমন সব সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, যেগুলো দেশের রাজনৈতিক ও বিচারব্যবস্থার গতিপথ আমূল পরিবর্তন করেছে।
তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ, তাঁর দেওয়া একাধিক রায়, এবং অবসরের পর রাষ্ট্রীয় ‘লাভজনক’ পদ গ্রহণ সব মিলিয়ে বিচারপতি খায়রুল হকের নাম আজ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বিচারব্যবস্থার অন্যতম বিতর্কিত নাম হিসেবে পরিগণিত।
অবসর নেওয়ার কিছুদিন পরই বিচারপতি খায়রুল হক আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অথচ, তিনি নিজেই তাঁর এক রায়ে বলেছিলেন- “অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদ গ্রহণ করতে পারবেন না।”
এই দ্বিমুখী অবস্থান শুধু তাঁর নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, বরং দেশের বিচারব্যবস্থাকে জনগণের সামনে বিব্রতকর অবস্থানে এনে দিয়েছে।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর যতজন প্রধান বিচারপতি এসেছেন, তাঁদের কেউই রাষ্ট্রীয় বা আধা-রাষ্ট্রীয় পদে চাকরি গ্রহণ করেননি, শুধু খায়রুল হকই ব্যতিক্রম।
২০১০ সালের বহুল আলোচিত ত্রয়োদশ সংবিধান সংশোধনী বাতিলের রায়ে বিচারপতি খায়রুল হক সংক্ষিপ্ত রায়ে বলেছিলেন- “দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে পারে।”
কিন্তু বিস্ময়করভাবে, অবসরের ১৬ মাস পর প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে তিনি এই ঘোষণাটি সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে দেন। এতে দেখা যায়, একজন প্রধান বিচারপতি নিজের সংক্ষিপ্ত আদেশ থেকে রায় সম্পূর্ণ পাল্টে দেন, যা বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার উপর বড় ধরনের আঘাত।
এমন পরিস্থিতিতে পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি এস.কে. সিনহা বাধ্য হয়ে নিয়ম প্রণয়ন করেন যে, অবসরের ছয় মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করতে হবে যাতে রায় বিকৃতি না ঘটে।
ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে সুপ্রিম কোর্টের সাতজন বিচারপতির মধ্যে তিনজন রায়ের সঙ্গে একমত হননি। এছাড়া শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি যাঁদের মতামত গ্রহণ করেছিলেন, সেই আটজন সিনিয়র আইনজীবীর মধ্যে সাতজনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানসম্মত বলে মত দিয়েছিলেন।
কিন্তু বিচারপতি খায়রুল হক সেইসব যুক্তি উপেক্ষা করে যে রায় দেন, তাতে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
খায়রুল হক দায়িত্ব পালনকালে একের পর এক রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষক স্বীকৃতি,নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের অপসারণে বৈধতা প্রদান,বেগম খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ,দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দণ্ড
এসব রায় সুস্পষ্টভাবে একটি পক্ষের রাজনৈতিক এজেন্ডাকে বৈধতা দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে, যার ফলে আদালতের নিরপেক্ষতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
অবসরের পরও খায়রুল হক টেলিভিশন ও সংবাদমাধ্যমে ঘনঘন সাক্ষাৎকার দিয়ে সরকারের পক্ষে কথা বলেন, বিতর্কিত রায়ের ব্যাখ্যা দেন এবং বিরোধী মতকে আক্রমণ করেন। যা বিচার বিভাগের রীতিনীতি, মর্যাদা ও নিরপেক্ষতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থাতেও তিনি সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট বক্তব্য দিতে থাকেন—যা তাঁর পদ ও দায়িত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এই পর্যায়ে এসে বড় প্রশ্ন দাঁড়ায়—বিচারিক দায়িত্ব পালনকালে দেওয়া রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক রায় কি “হত্যা মামলা”র আওতায় পড়ে?
অ্যাডভোকেট মোঃ আরিফুর রহমান শ্রাবণ বলেন—
“বিচারপতির সিদ্ধান্ত বিতর্কিত হতে পারে, পক্ষপাতদুষ্টও হতে পারে—কিন্তু সেটি কখনোই ফৌজদারি হত্যাকাণ্ডে রূপ নেয় না। বিচারিক দায়িত্বের অপব্যবহার হলে তার জন্য সাংবিধানিক বা প্রশাসনিক তদন্ত হওয়া উচিত, হত্যার দায়ে বিচার নয়।”
তিনি আরও বলেন, “এই মামলার প্রেক্ষাপটে আদালতের ভবিষ্যত স্বাধীনতা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। বিচারপতিরা ভয় পাবেন আজকের সিদ্ধান্ত কাল হত্যার অভিযোগ হয়ে যেতে পারে।”
রাষ্ট্র চাইলে অন্যভাবে খায়রুল হকের দায় নির্ধারণ করতে পারত, যেমন: সাংবিধানিক লঙ্ঘনের অভিযোগে কমিশন গঠন,রায়ের আইনি বৈধতা পর্যালোচনা,আইন কমিশনের দায়িত্ব পালনের নিরপেক্ষ তদন্ত
কিন্তু এসব না করে সরাসরি ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত করা আইন ও বিচারব্যবস্থাকে প্রতিশোধমূলক প্রতিচ্ছবি হিসেবে উপস্থাপন করে।
খায়রুল হক বিচার বিভাগের ইতিহাসে বিতর্কিত ব্যক্তি এ বিষয়ে দ্বিমত নেই। তবে তাঁকে যদি জবাবদিহির আওতায় আনতেই হয়, তবে তা আইনি, ন্যায়সঙ্গত এবং সংবিধানসম্মত প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত।
অন্যথায়, বিচার বিভাগের পবিত্রতা আর বিচারপতিদের স্বাধীনতা দুই-ই গুরুতর হুমকির মুখে পড়বে।
এই প্রতিবেদনটি একটি বিশ্লেষণাত্মক মতামতভিত্তিক রিপোর্ট, যার উদ্দেশ্য হলো গণমাধ্যমে চলমান বিতর্কের আলোকে তথ্য-ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন। এটি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপ্রসূত নয়।
এসময়/