
মো. শাহজাহান বাশার ,সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার:
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতিত শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন, সুবিধাভোগী এবং বিতর্কিত কর্মকর্তারা এখনো প্রশাসনের নানা গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছেন। শীর্ষ পদে পরিবর্তনের পরও প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থায় পুরনো গোষ্ঠীর প্রভাব অটুট রয়েছে। তাদের সুরক্ষার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তত চারজন উপদেষ্টা সরাসরি ‘প্রটেকশন’ দিচ্ছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
পুরনো গোষ্ঠীর গোপন বৈঠক ও ‘আমলা বিদ্রোহ’-এর শঙ্কা
প্রশাসনিক অনুসন্ধানে জানা যায়, শেখ হাসিনার আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত অধিকাংশ সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও প্রভাবশালী কর্মকর্তা নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন। নিয়মিত গোপন বৈঠক করে তারা যেন সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন। সচিবালয়ের অভ্যন্তরীণ মহল আশঙ্কা করছে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে এলেই তারা ১৯৯৬ সালের মতো ‘আমলা বিদ্রোহ’ সংগঠিত করতে পারে। সে সময় খালেদা জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তারা ‘জনতার মঞ্চ’ গড়ে তোলেন এবং সচিবালয়ে বিদ্রোহ করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
সচিবালয় সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের চারজন উপদেষ্টা নিজেদের মন্ত্রণালয়ে আওয়ামীপন্থী সচিব ও অতিরিক্ত সচিবদের রক্ষায় সক্রিয়। তারা মৌখিকভাবে নির্দেশ দিয়েছেন— তাদের অনুমতি ছাড়া কোনো কর্মকর্তা বদলি বা পদায়ন করা যাবে না। এর ফলে ফ্যাসিস্ট আমলের বহু বিতর্কিত কর্মকর্তা আগের মতোই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, বরং কেউ কেউ পদোন্নতিও পাচ্ছেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—ফারহিনা আহমেদ, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব, ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী, স্বপদে বহাল।নাজমুল আহসান, সাতক্ষীরা হত্যাযজ্ঞের নির্দেশদাতা হিসেবে চিহ্নিত, বর্তমানে পানিসম্পদ সচিব।ড. খায়রুজ্জামান, অর্থ সচিব, পরিচিত সালমান এফ রহমান ও পলাতক গভর্নর রউফের ঘনিষ্ঠ হিসেবে।শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী, ইআরডি সচিব, হাসিনার ঘনিষ্ঠ ইসমত আরা সাদিকের সাবেক পিএস। নাজমা মোবারক, এনবিআর কর্মকর্তা, পলাতক গভর্নর রউফ ও সাবেক অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকার বন্ধু— বহাল তবিয়তে আছেন।
হাসিনাপন্থী হিসেবে চিহ্নিত অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সিরাজুন নূর চৌধুরী ও ইআরডি অতিরিক্ত সচিব একেএম শাহাবউদ্দিন ইতোমধ্যে সচিব পদে উন্নীত হয়েছেন। একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির অন্যতম অভিযুক্ত মেজবাহ উল হকের স্ত্রী তসলিমা কানিজ নাহিদও সচিব হয়েছেন। অথচ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে পদোন্নতিপ্রাপ্ত যোগ্য অতিরিক্ত সচিবদের ক্ষেত্রে ‘অভিজ্ঞতার অভাব’ দেখিয়ে সচিব পদে উন্নীত করা হচ্ছে না।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সরকারি আদেশ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জুলাই আন্দোলনের সমর্থক বা দীর্ঘদিন বঞ্চিত কর্মকর্তাদের প্রতি অবহেলা করা হচ্ছে। বিপরীতে, টুঙ্গিপাড়া বা ধানমন্ডি ৩২-এ গিয়ে শেখ হাসিনাকে ফুল দিয়ে সমর্থন জানানো কর্মকর্তারা সহজেই পদোন্নতি পাচ্ছেন।
অবসরপ্রাপ্ত সচিব, অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ও বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি এবিএম আবদুস সাত্তার শুক্রবার বিয়াম মিলনায়তনে এক সেমিনারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন—
“আমার ব্যাচমেট ও বন্ধু মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব ও জনপ্রশাসন সচিব ফোন করলেও রিসিভ করেন না। ফ্যাসিস্ট আমলের অপরাধী আমলাদের অপসারণে কোনো উদ্যোগ নেই। ১৭ বছর বঞ্চিত ও নির্যাতিত কর্মকর্তাদের যথাযথ পদায়ন-পদোন্নতিও হচ্ছে না— এটা দুঃখজনক।”
তিনি আরও অভিযোগ করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আটজন উপদেষ্টার দুর্নীতির প্রমাণ তার কাছে রয়েছে এবং এই উপদেষ্টাদের অনুমতি ছাড়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ বা বদলি হয় না।