এস চাঙমা সত্যজিৎ, স্টাফ রিপোর্টারঃ
২০২৪ সালে ঘটনাবহুল পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বম জনগোষ্ঠির লোকজন।
২ ও ৩ এপ্রিল রুমা ও থানচিতে পৃথক ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) দমনের নামে ৭ এপ্রিল থেকে চালানো হয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর অভিযান।
রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচিসহ আশে-পাশের এলাকায় পরিচালিত অভিযানে বম জনগোষ্ঠির নারী-পুরুষ, শিশু, শিক্ষার্থীসহ নির্বিচারে গ্রেফতার করা হয়।
চালানো হয় কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড।
জারি করা হয় চালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা।
অভিযানের ফলে ভীতসন্তস্ত্র বম জনগোষ্ঠির অন্তত দুই শ লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বনে-জঙ্গলে ও ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
ভানথাংপুই বম (১৩)।
এপ্রিল থেকে চলা যৌথ বাহিনীর অভযানে ৫ম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক স্কুল ছাত্রসহ অন্তত ২১ জনকে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে গুলি করে বিচার বহির্ভুতভাবে হত্যা করা হয়।
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে- ২২ এপ্রিল রুমা উপজেলার মুনলাই পাড়ায় লালমের রুয়াত বম (২৮) নামে বান্দরবান কলেজের বিএ (অনার্স) পড়ুয়া এক ছাত্রকে হত্যা করা হয়; ২৮ এপ্রিল রুমা ও থানচির সীমান্তবর্তী বাকলাই পাড়া এলাকায় দু’জন বম-এর গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়; ২ মে রোয়াংছড়ি উপজেলার পাইক্ষ্যং পাড়া এলাকা গ্রামের কার্বারিসহ ৫ জনকে গুলি করে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার অভিযোগ পাওয়া যায়; ৭ মে বান্দরবানের রুমা উপজেলার কেওক্রাডং পাহাড় সংলগ্ন দার্জিলিং পাড়া এলাকায় নিমুন বম (৪০) নামে একজন সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন; ১৯ মে রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী ডেবাছড়া সেনাবাহিনীর অভিযানের সময় এডিথাং বম, নুয়াম বম ও রুয়ালমিন লিয়ান বম নামে তিন ছাত্র ও ফুটবল খেলোয়াড়কে গুলি করে হত্যা করা হয়; ২৩ মে সুয়ালক ইউনিয়নের শ্যারন পাড়া এলাকায় ভানথাংপুই বম (১৩) নামে ৫ম শ্রেণির এক ছাত্র ও লালনৌ বম (২২) নামে অপর একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়; ১২ জুন ২০২৪, বান্দরবানের রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের জুরভারাং পাড়া এলাকা থেকে ভানলাল খিয়াং বম নামে এক ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
যৌথ বাহিনীর অভিযানকালে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে জানা যায; ২৬ জুন ২০২৪ বান্দরবানে রুমা-থানচি সীমান্তবর্তী সিমতস্নাংপি পাড়া এলাকায় লালঅপ লিয়ান বম নামে এক ব্য্যক্তি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন; ২৪ জুলাই রুমা সদর ইউনিয়নের সাইকট পাড়া এলাকায় যৌথবাহিনীর অভিযানে গুলিতে বম জাতিসত্তার ২ জন নিহত হন বলে জানা যায়; ২৪ নভেম্বর বান্দরবানে রুমা উপজেরার মুননুয়াম পাড়া এলাকায় সেনাবাহিনীর অভিযানকালে গুলিতে এল্ডার পেনখুপ, মেসি ভাললালসিয়ান ও এলি ভানজিপার নামে বম জাতিসত্তার তিন জন নিহত হন।
যৌথ বাহিনীর অভিযানকালে ব্যাপক ধরপাকড়ের ঘটনা ঘটে। শুধু বম জনগোষ্ঠি নয়, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির লোকজনও আটক-হয়রানির শিকার হন। অভিযানে এ পর্যন্ত অন্তত ১৫১ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ-শিক্ষার্থী কেউই এই ধরপাকড় থেকে বাদ যায়নি।
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আকারের গ্রেফতারের ঘটনাটি ঘটে ৮ এপ্রিল তারিখে।
ঐদিন নারী-পুরুষসহ ৪৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
অবশ্য আটককৃতদের মধ্য থেকে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজনসহ ২০ জনকে হয়রানি শেষে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানা যায়।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও বম জনগোষ্ঠির গ্রেফতারকৃত লোকজন এখনো মুক্তি পায়নি।
এখনো আগের মতোই যৌথ বাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও সেখানে এক নারীসহ তিন জন বমকে বিচার বহির্ভুতভাবে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।