মো. শাহজাহান বাশার
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার সুয়াগাজী নামক স্থানে বন বিভাগের চেক স্টেশনে দীর্ঘদিন ধরে চলছে টিপি (ট্রানজিট পারমিট) চেকের নামে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি। প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা, সপ্তাহে ৭ দিন, মাসে আল্লাহর ৩০ দিন, এমনকি বছরে ৩৬৫ দিনই এই চেকপোস্টে অবৈধভাবে টাকা আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একমাত্র দুই ঈদের দিন বাদে সারা বছরই বনজ দ্রব্য বোঝাই গাড়িগুলোর কাছ থেকে টিপি চেকের নামে ঘুষ বা চাঁদা নেওয়া হয়— এমনই তথ্য উঠে এসেছে অনুসন্ধানে।
খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজারসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম ও উপকূলীয় অঞ্চল থেকে প্রতিদিন শত শত গাড়ি বনজ দ্রব্য যেমন— গাছ, কাঠ, বাঁশ, ফুলের ঝাড়ু, মৌসুমি ফল ও বিভিন্ন ধরনের বনজ পণ্য বোঝাই করে কুমিল্লার দিকে আসে। এই গাড়িগুলোকে সুয়াগাজী চেক স্টেশনে প্রবেশের পর টিপি চেকের নামে বিভিন্ন অংকের টাকা দিতে হয়।
স্থানীয় বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, বন বিভাগের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তার যোগসাজশে এই চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে— কুমিল্লা বন বিভাগের ডিএফও (Divisional Forest Officer) এর অব্যক্ত অনুমোদন ও রেঞ্জ কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ নির্দেশে স্টেশন কর্মকর্তা ও কর্তব্যরত কর্মচারীরা প্রকাশ্যে চাঁদা আদায় করে আসছে।সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সুয়াগাজী চেক স্টেশনের সামনে প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বনজ দ্রব্যবোঝাই ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ ও ছোট পণ্যবাহী যানবাহন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিটি গাড়ির চালক বা চালানদারকে চেক স্টেশনের কর্মচারীরা ‘টিপি চেক’-এর অজুহাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে বাধ্য করছে। টাকা না দিলে গাড়ি আটক, মামলা দেওয়া কিংবা মাল জব্দ করার ভয় দেখানো হয়।
সুয়াগাজীর আশপাশের এলাকাবাসী ও কাঠ ব্যবসায়ীরা গণমাধ্যমকে জানান,
“আমরা বৈধভাবে ব্যবসা করি, সরকারকে ভ্যাট ও ট্যাক্স দিই। তারপরও চেক স্টেশনে আসলেই টিপি চেকের নামে টাকা দিতে হয়। না দিলে গাড়ি আটক রেখে হয়রানি করা হয়।”
একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাঠ ব্যবসায়ী আরও বলেন,
“গাড়ি প্রতি ন্যূনতম ২,২০০ টাকা থেকে শুরু করে মালের ধরন ও গাড়ির সাইজ অনুযায়ী ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকাও দিতে হয়। টাকা না দিলে গাড়ি ছাড়ে না, মামলা দেয়ার ভয় দেখায়।”
ড্রাইভার ও হেলপারদের অভিযোগ— এই চাঁদাবাজি এতটাই সংগঠিতভাবে চলে যে, কোনো গাড়ি টাকা না দিয়ে পাস করতে পারে না।
কুমিল্লা বন বিভাগের নগরীর শাকতলা বিভাগীয় অফিসে এই চাঁদাবাজির বিষয়ে একাধিকবার অভিযোগ ও আলোচনা হলেও বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গণমাধ্যমের সামনে চাঁদাবাজির অভিযোগের সত্যতা স্বীকার না করে বরং আশ্বাসমূলক বক্তব্য দিয়ে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন।
একাধিক কাঠ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন,
“প্রতিবারই বলে ব্যবস্থা নেবে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। বরং যারা অভিযোগ করে, তাদের পরবর্তীতে আরও বেশি হয়রানি করা হয়।”এমন প্রকাশ্য চাঁদাবাজি চলতে থাকলেও জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন কিংবা বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কার্যকর নজরদারি নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়রা মনে করেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নীরব ভূমিকা এই চাঁদাবাজির মূল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একজন স্থানীয় সচেতন নাগরিক বলেন,
“দিনের আলোয় প্রকাশ্যে টাকা আদায় হয়, অথচ কেউ কিছু দেখে না, শোনে না। এটা চরম দুর্নীতির উদাহরণ। সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে, আর জনগণের হয়রানি বাড়ছে।”
বনজ সম্পদ দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বন বিভাগের একটি চেক স্টেশনে এইভাবে বছরের পর বছর চাঁদাবাজি চলতে থাকলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বৈধ ব্যবসায়ীরাও নিরুৎসাহিত হবে। স্থানীয় ব্যবসায়ী, চালক ও সাধারণ মানুষ দ্রুত প্রশাসনের কার্যকর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
বন বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি দপ্তরে যদি প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি চলে, তাহলে তা শুধু একটি দুর্নীতির ঘটনা নয়— এটি রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও ন্যায়ের প্রতি চরম অবমাননা। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি, যাতে বনজ সম্পদ ও ব্যবসা সুরক্ষিত থাকে এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ না হয়।
মোঃ শাহজাহান বাশার